রাধারানীর জন্মলীলা

Spread the love

জগৎশক্তি তিন প্রকার- পদ্মিনী, শাশ্বত ও হ্লাদিনী। শ্রীকৃষ্ণ পদ্মিনী শক্তির মাধ্যমে জগৎ সৃষ্টি করেন। শাশ্বত শক্তির মাধ্যমে তিনি নিজেকে জানতে পারেন এবং জীবেরা শ্রীকৃষ্ণ কে জানতে পারেন। হ্লাদিনী শক্তির মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ আনন্দ উপভোগ করেন এবং জীবেরা কৃষ্ণপ্রেম আস্বাদন করেন। এই হ্লাদিনী শক্তির প্রতিমূতি হলেন শ্রীমতি রাধারানী।

ব্রহ্মহ্মবৈবত ‘পুরাণে বলা হয়েছে- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোলোক বৃন্দাবনে মাধবী লতার কুঞ্জে রত্নসিংহাসনে উপবেশন করে লীলাবিলাসের ইচ্ছা প্রকাশকরা মাত্রই তাঁর বাম অঙ্গ থেকে অপূর্ব রূপ মাধুরী সম্পন্না শ্রীমতি রাধারানী প্রকাশিত হলেন। তাঁর অঙ্গকান্তি ছিল তপ্তকাঞ্চন বর্ণ এবং তিনি সমস্ত দিব্য অলংকারে ভূষিতা ছিলেন। তখন শ্রীমতি রাধারানী নিজের কায়ব্যূহ থেকে অসংখ্য গোপী রূপে নিজেকে বিস্তার করে সর্বতোভাবে শ্রীকৃষ্ণের আনন্দ বিধান করলেন। এভাবেই শ্রীকৃষ্ণ তাঁর হ্লাদিনী শক্তি শ্রীমতি রাধারানী ও গোপীকা গণের সঙ্গে মাধুর্য্যরসে নিত্য লীলাবিলাস করেন।

পদদ্মপুরাণে বলা হয়েছে, দেবকার্য সাধনে পৃথিবীর ভার অপহরণের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মার দিবসেরমধ্যে একবার এই পৃথিবীতে অবতরণ করলে পরপুরুষের মুখ দর্শন করতে হবে। এই ভয়ের কথা শ্রীমতি রাধারানী জ্ঞাপন করলে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে অভয়প্রদান করেন।

যথা সময়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোকুলে নন্দ- যশোদার পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করলেন এবং ভাদ্রমাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে মধ্যাহ্নে বিশাখা নক্ষত্রে সর্বশুভোদয় মুহূর্তে রাজা বৃষভানু-কীর্তিদার কন্যারূপে শ্রীমতি রাধারানী গোকুলের অন্তর্গত রাভেলে জন্ম গ্রহন করেন। রাধারানীর তপ্তকাঞ্চন বর্ণেরছটায় গৃহটি আলোকিত হল। পরপুরুষ দর্শনের ভয়ে যেহেতু তিনি চোখ বুজেছিলেন, তাইকন্যা সন্তানটিকে জন্মান্ধ মনে করে সকলে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তখন নারদ মুনি এসে তাঁদের সন্দেহ দূরকরে আশ্বাস প্রদান করেন যে, যথাসময়ে কন্যা চক্ষু ফিরে পাবেন।

রাধারানীর জন্মোৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে শিশু-কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে নন্দ-যশোদা বৃষভানু রাজার গৃহে উপস্থিত হলেন। নন্দ মহারাজকে রাজা বৃষভানু ও যশোদামাকে কীর্তিদা যখন আলিঙ্গন করছিলেন, তখন কৃষ্ণ হামাগুড়ি দিয়ে রাধারানীর পালঙ্কের কাছে এসে তার চোখে হাত দিতেই রাধারানী কৃষ্ণের দিকে তাকান। এভাবেই উভয়উভয়কে দর্শন করে প্রেমানন্দে অভিভূত হয়ে পড়েন।

এদিকেসকলে শিশুদুটির কাছে এসে দেখেন রাধারানী চক্ষু উন্মীলন করে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে আছেন। তখন আনন্দে রাজা বৃষভানু কৃষ্ণকে কোলে তুলে নিলেন এবং বললেন কৃষ্ণই রাধারানীর চক্ষু প্রদান করেছেন। তারপর মহানন্দে রাধারানীর জন্মোৎসব পালিত হয়।

শ্রী গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের অপ্রাকৃতযুগল- মাধুরী হলো সর্বশ্রেষ্ঠ উপাস্য তত্ত্ব।

লীলা পুরুষোত্তমশ্রীকৃষ্ণ হলেন সর্বশক্তিমান আর শ্রীমতি রাধারানী হলেন হ্লাদিনী রূপা স্বরূপ শক্তি, শ্রীকৃষ্ণের প্রেমের বিকার। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে-

“রাধিকা হয়েন কৃষ্ণেরপ্রনয় বিকার। স্বরূপশক্তি- হ্লাদিনী নামযাহার।।”

শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপতঃ এক আত্মা। কিন্তু এক আত্মা হলেও, তাঁদের দেহ ভেদ না থাকলে ও অনাদি কাল হতেই তাঁরা দুটি দেহ ধারণ করে আছেন লীলারস আস্বাদন করার জন্য।

লীলার নিমিত্তই দুটি দেহের প্রয়োজন, কারন একাকী লীলা হয়না। “রাধা- কৃষ্ণ এক আত্মা দুইদেহধরি।

অন্যোন্যে বিলাসেরসআস্বদনকরি।।” শক্তিমান ও শক্তির বিলাস বৈভবের নামলীলা। হ্লাদিনী স্বরূপ শক্তির সহিত

পুরুষোত্তমশ্রীকৃষ্ণের যে লীলা তাকে নিত্যলীলা বা চিদ্বিলাবলে। জড়জগতের হেয়তা এখানে স্পর্শ করে না অর্থাৎ জড়জগতের জুগুপ্সিতভাব এখানে নাই। সেই নিত্যজগতে শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের নিত্যলীলা সর্বদা নব নবায়মান সৌন্দর্য মাধুর্যেভরা, নিত্যনবোল্লাসরসেপূর্ণ অনন্ত বৈচিত্রময়। আমাদের এই পার্থিব জগতের অতৃপ্ত কামনাময় অপূর্ণ ‘হৃদয় সেই নিত্যধামে নিত্য ও পূর্ণ বস্তুর সেবায় পরম পরিতৃপ্তি লাভ করে। সেই নিত্যধাম গোলক হতে শ্রীমতি রাধারানী ভৌমব্রজমন্ডলে অবতরণের উদ্দেশ্য হলো মধুররসাশ্রিত জীব সমূহের নিগূড় সেবায় পথ প্রদর্শন। আর সেই শ্রীরাধাকৃষ্ণের সেবায় শ্রীমতি রাধারানীর পরিচারিকা রূপে আত্মনিয়োগ করাই সাধনভজনের চরম ও পরমপ্রাপ্তি। তাঁরদাস্যই নিখিলনরনারীর চরমতম সাধনার পরমতম বস্তু প্রাপ্তির মূলকারণ।

জন্মজন্মান্তর ধরে নিজস্বরূপ ভ্রষ্ট জীবসমূহ অনন্ত দুঃখের সাগরে ভাসমান হয়ে চুরাশীলক্ষজন্ম পরিক্রমা করে চলছে। এই জীবসমূহ উদ্ধারের জন্য বেদ- পুরাণাদি বহুশাস্ত্রে বহুসাধন পন্থা, যেমন- কর্মেভুক্তি, জ্ঞানে মুক্তি, যোগে সিদ্ধিলাভের কথা থাকলেও শ্রীকৃষ্ণের চরণ কমলের নিত্য সেবাসুখ লাভের সম্ভবনা নাই। শ্রীকৃষ্ণের নিত্যসেবা লাভই জীবের নিত্যস্বরূপ প্রতিষ্ঠিত হবার একমাত্র উপায়। তাই শ্রীমতি রাধারানীর প্রাণ ত্রিতাপ দুঃখজ্বালায়জর্জরিত জীবের জন্য কেঁদে উঠল নিজস্বরূপভ্রষ্ট জীবসমূহকে পরম অমৃতময় পথের সন্ধান দিতে।

শ্রীকৃষ্ণ সেবা হতে জীবকে নিত্য সেবায় নিযুক্ত করতে হলে অনিত্যের প্রতি আসক্তি দূর করে শ্রীকৃষ্ণ সেবায় উন্মুখী করাই করুণাময়ী শ্রীমতি রাধারানীর ইচ্ছা। এটি তার জীব উদ্ধারণলীলার পূর্বভাস। এটি অপরের দ্বারা সম্ভব নয়। নিজের জীবনআচরণ করে শ্রীকৃষ্ণসেবা রূপ সুনির্মল সুখ হতে বঞ্চিত জীবকে শ্রীকৃষ্ণ সেবায় উন্মুখী করতে পারলেই জীবের বাস্তব মঙ্গল। স্বয়ং গোলোকেশ্বরী শ্রীমতি রাধারানী এভাবে চিন্তা করতে করতে প্রাপঞ্চিক লীলারসময় এসে উপস্থিত হলো। পাঁচসহস্রাধিক বৎসর পূর্বে গত দ্বাপর যুগের শেষ ভাগে সোয়াশতবৎসর কাল ভৌমলীলা করবার অভিপ্রায় গোলোক হতে ভূলোকের ব্রজমন্ডলে তিনি ভাদ্রমাসে শুক্লাষ্টমী তিথিতে সোমবার মধ্যাহ্ন কালে রাভেলনামক গ্রামে বৃষভানু রাজার গৃহে কীর্তিদা দেবীরগর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।

দুর্বারগতিতে শ্রীকৃষ্ণ প্রেমসিন্ধ মাঝে পতিত হয়ে কায়- মন- বাক্যের যে গতি সেটি হলো শ্রীমতি রাধারানীর কৃষ্ণ ভজনের মূল সূত্র, এটিই তাঁর নিত্যপ্রাণ প্রিয় শ্রীকৃষ্ণের সেবা পদ্ধতি- যা চিরকাল শ্রীমতি রাধারানীর বিশুদ্ধ চিত্তে নিবন্ধ ছিল। জীবজগতে এটি অনর্পিত ছিল। কৃপাময়ী শ্রীমতি রাধারানীর ইচ্ছা হলো এই পন্থারদ্বারা জগৎজীবকে তাঁর প্রিয়সহচরী করে প্রানদয়িত শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিযুক্ত করবেন। শ্রীমতি রাধারানী সচ্ছিদানন্দময়ী, কৃষ্ণপ্রেমেরআধারস্বরূপিনী, মহাভাব বিভাবিতা, সর্বলক্ষ্মীময়ী, তাঁর কোনো কামনা বা বাসনার ইচ্ছা হয়না। তিনি নিত্যকাল আত্মকামা, আত্মরামা, তবে জগৎ জীবকে তাঁর সহচরী করার ইচ্ছা জাগ্রত হলো কেন? ভক্ত বাৎসল্য হেতু কৃপাশক্তির সঞ্চালনে তাঁর এরূপ আহৈতুকী ইচ্ছার উদয় হলো। তাঁর এই ইচ্ছা সমস্ত জগৎ জীবের কল্যাণের জন্য। এটি জীবের পক্ষে মঙ্গলের আলয় স্বরূপ। বিষয় বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত রসের আকর। সেই রস ঘনীভূত হয়ে পরিণামে বিশুদ্ধ প্রেমের উদ্ভব হয়, আর তা আশ্রয়জাতীয় বিগ্রহস্বরূপিনী শ্রীমতি রাধারানীর চিত্তগত কৃষ্ণসেবার পরিপাকে সমুৎপন্নহয়। সেই জন্য হ্লাদিনী প্রধানা শ্রীমতি রাধারানী শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের ভান্ডারী। কৃপাময়ী শ্রীমতি রাধারানী কৃপা করে যাকে তা প্রদান করবেন তিনি শুধুমাত্র তার অধিকারী হবেন। ত্রিকালের সমস্ত সৌন্দর্য- মাধুর্যেরঘনীভূতা লাবণ্যসার শ্রীমতি রাধারানীর আজ শুভ আবির্ভাব তিথি। তিনি সমস্ত জীবজগতের প্রতিশুভ দৃষ্টিপাতপূর্বক পরমমঙ্গল করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *