
বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এক সময় এক মানুষ ছিলেন—চশমার আড়ালে লাজুক হাসি, মুখে অনাবিল সরলতা, অভিনয়ে গভীর বাস্তবতা। তাঁর নাম কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়। বহু দশকের অভিনয় জীবনে যিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রতিটি মধ্যবিত্ত বাঙালির পরিচিত মুখ, সিনেমার এক অপরিহার্য অংশ। ২০২৫ সালের ৭ ডিসেম্বর তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেও তাঁর জীবন ও শিল্পকে ঘিরে গল্প আজও মানুষের মনে অমর হয়ে রয়েছে।
১৯৪২ সালে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কল্যাণ। ছোটবেলা থেকেই নাটক, গান আর সিনেমার প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল তাঁর। পাড়ার যাত্রাপালা, স্কুলের নাটক—যেখানে যা সুযোগ পেতেন, সেখানেই নিজের দক্ষতা দেখাতে ভোলেননি। কিন্তু কখনও ভাবেননি তাঁর সহজ-সরল মুখটাই একদিন বাংলা চলচ্চিত্রের শক্তিশালী চরিত্র অভিনেতাদের তালিকায় জায়গা করে নেবে।
যৌবনে তিনি কলকাতায় আসেন পড়াশোনার জন্য। সেই সময়েই থিয়েটার দলের সাথে যুক্ত হন। অভিনয় ছিল তাঁর নেশা; আর নেশাটাই ধীরে ধীরে পেশা হয়ে ওঠার পথ তৈরি করছিল।
১৯৬৮ সাল—কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে এক মোড় ঘোরানো বছর। সেই বছর মুক্তিপ্রাপ্ত Apanjan ছবিতে তিনি প্রথম বড় পর্দায় অভিনয়ের সুযোগ পান। ছবিটি ছিল সামাজিক বাস্তবতায় ভরা, আর কল্যাণের অভিনয়ের সরল স্বাভাবিকতা দৃষ্টি কাড়ে সবার। সেদিন থেকেই শুরু হয় দীর্ঘ কর্মজীবনের পথচলা।
পরের কয়েক বছরেই তিনি দর্শকের চোখে “পরিচিত মুখ” হয়ে ওঠেন। তাঁর অভিনয়ে ছিল না অতিরঞ্জন, ছিল না কৃত্রিমতা—ছিল শুধু জীবনের সহজ সত্য। এরই মাঝে Dhonni Meye, Sagina Mahato, Mouchak, Agnishwar, Mayer Anchal—এমন অসংখ্য ছবিতে তিনি হয়ে ওঠেন গল্পের গাঢ় রং।
কল্যাণ চট্টোপাধ্যায় কখনও নায়ক হননি, কিন্তু তিনি ছিলেন এমন অভিনেতা যার অনুপস্থিতি গল্পকে অসম্পূর্ণ করে দেয়। চায়ের দোকানের মালিক, দোকানি, সাদামাটা অফিসকর্মী, আত্মীয়—যে চরিত্রই তিনি করেছেন, তা দর্শক মনে গেঁথে গেছে স্বাভাবিকতার জন্য।
নাটকেও সমান দক্ষ ছিলেন তিনি। মঞ্চের ভাষা, অভিব্যক্তি আর শক্তিশালী উপস্থিতি তাঁকে থিয়েটার দুনিয়াতেও সম্মান এনে দেয়। পরে তিনি টেলিফিল্ম ও টিভি সিরিয়ালেও অভিনয় করেন—ফলে নতুন প্রজন্মও তাঁর সহজ অভিনয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে।
৪০০–র বেশি চলচ্চিত্রে কাজ করা কল্যাণ চ্যাটার্জি বাংলা সিনেমার এক অমূল্য সম্পদ। তিনি প্রমাণ করে গিয়েছেন, নায়ক না হয়েও দর্শকের হৃদয় জয় করা সম্ভব, যদি শিল্পের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা থাকে।
বার্ধক্যের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীর দুর্বল হতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। চিকিৎসার মধ্যেই ছিলেন, তবে পরিবার ও সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ তিনি কমাননি। সহ-অভিনেতারা বলেন, শেষ দিকেও তিনি অভিনয় নিয়ে আলোচনা করতেন; সিনেমা ছিল তাঁর প্রাণ।
একটি যুগের অবসান
৭ ডিসেম্বর ২০২৫, রবিবার, রাত ৮টা ৪০ মিনিটে কলকাতার বাঙ্গুর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়। বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই টলিউডে নেমে আসে শোকের ছায়া। বহু পরিচালক, অভিনেতা, শিল্পী স্মরণ করেন তাঁর উজ্জ্বল কর্মজীবন ও নিভৃতচারী ব্যক্তিত্ব।
চলে গেলেও রয়ে গেলেন
কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ের জীবনটা ছিল নিঃশব্দে কাজ করে যাওয়ার গল্প। তিনি কোনও দিন প্রচারের আলো খোঁজেননি, কিন্তু তাঁর কাজই তাঁকে মানুষের মনে স্থায়ী জায়গা দিয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্র যখনই চরিত্র অভিনয়ের উদাহরণ দেবে, কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ের নাম সেখানে সোনালি অক্ষরে লেখা থাকবে।