দেবাদিদেব মহাদেবের শ্রাবণ মাসের গুরুত্ব

Spread the love

( সুবল মণ্ডল, কলকাতা )দেবাদিদেব মহাদেব, যিনি ত্রিলোকের অধীশ্বর, তাঁর আরাধনার সর্বোত্তম মাস হলো শ্রাবণ। শ্রাবণ মাস শিবের আরাধনা ও তপস্যার জন্য বিশেষভাবে পবিত্র বলে গণ্য। এই মাসে ভক্তরা উপবাস, ব্রত, রুদ্রাভিষেক, কাঁবরিয়া যাত্রা, শিবের বিভিন্ন রূপের আরাধনা ইত্যাদি আচার পালন করেন। শাস্ত্র মতে, শ্রাবণ মাসের শিবপূজায় অশেষ পুণ্য অর্জিত হয় এবং জীবনের যাবতীয় পাপ ক্ষয় হয়।
শ্রাবণ মাসের পেছনে রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক কাহিনী। শিব পুরাণ ও স্কন্দ পুরাণ অনুসারে, শ্রাবণ মাসেই দেবতা ও অসুরেরা সমুদ্র মন্থন করেন। মন্থনের ফলে উঠে আসে ‘হলাহল’ নামে এক ভয়ঙ্কর বিষ, যা সমস্ত সৃষ্টিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। তখন দেবতা-অসুর সবাই ভগবান শঙ্করের শরণাপন্ন হন।

করুণাময় শিব মহাবিষ পান করেন এবং তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে যায়, তাই তিনি ‘নীলকণ্ঠ’ নামে পরিচিত হন। তখন দেবতারা শিবের মাথায় গঙ্গাজল ঢালেন, যাতে বিষের প্রভাব কমে যায়। সেই থেকেই শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় গঙ্গাজল, দুধ, বেলপাতা প্রভৃতি নিবেদন করার প্রথা শুরু হয়।

“হে শম্ভু, হে নীলকণ্ঠ মহেশ,
সমুদ্র মন্থনে যবে উঠিল বিষ দেশ।
তুমি তাহা পান ক’রে করলে উদ্ধার,
ভক্তের দুঃখ ঘোচাও মহাপ্রাণ ধরাধার।।”

শ্রাবণ মাসের প্রতিটি সোমবার শিবের পুজো করার বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। এই দিনগুলোতে উপবাস করে শিবের নাম-জপ, ব্রত, আরাধনা করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়। বিশেষত, অবিবাহিত মেয়েরা এই ব্রত পালন করে উত্তম পতি লাভের আশায়। বিবাহিতরাও দাম্পত্য সুখ, সন্তান, ও সমৃদ্ধির জন্য ব্রত রাখেন।

শিব পুরাণে আছে:
“শ্রাবণেতে সোমবারে, শিবপূজা যেই জন,
তার সকল মনস্কামনা করে শঙ্কর পূরণ।
পুণ্য হয় জন্মান্তরে, নাশে পাপের ভার,
শিবলোক প্রাপ্তি হয়, কাটে সংসার-ভার।।”

শিবের আরাধনায় বেলপাতা অপরিহার্য। কারণ, বেলপাতার তিনটি পত্র ত্রিনেত্র, ত্রিশূল, ত্রিগুণের প্রতীক। ধুতুরা, আকন্দ, ভাঙ প্রভৃতি উদ্ভিদ শিবের প্রিয়, যা তাঁর ত্যাগী স্বভাবের পরিচায়ক।
গঙ্গাজল মহাপবিত্র, কারণ গঙ্গা নিজে শিবের জটায় স্থান পেয়েছেন। এই সব উপাচার দিয়ে শিবপূজা করলে জন্মজন্মান্তরের পাপ মোচন হয়।

“ত্রিলোকেশ ত্রিনয়ন, ত্রিশূলধারী শঙ্কর,
বেলপাতা ত্রিদল আনি করি তোমারে স্তব।
গঙ্গাজল, ধুতুরা দেই, করি তোমার পূজা,
দুঃখ নাশ করো প্রভু, নাশুক জন্মের ভুজা।।”

শ্রাবণ মাসে শিবলিঙ্গে রুদ্রাভিষেক করা অত্যন্ত পুণ্যজনক। এতে দুধ, দই, ঘি, মধু, চিনি, গঙ্গাজল দিয়ে শিবলিঙ্গ স্নান করানো হয়। সঙ্গে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র ও রুদ্রচরিত পাঠ করা হয়।

“আমরা ধ্যান করি ত্রিনয়ন শিবের,
যিনি সুগন্ধি, পুষ্টিদায়ক, জীবনের ফের।
যেন করলা ফল বিচ্ছিন্ন হয় ডাল থেকে,
তেমনই মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তি দাও আমাদেরকে।”

শ্রাবণ মাসে ‘বোল বম’, ‘কাঁবরিয়া যাত্রা’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভক্তরা গঙ্গা থেকে জল সংগ্রহ করে নির্জলা পদযাত্রা করেন, শিবমন্দিরে সেই জল নিবেদন করেন। এটি একপ্রকার তপস্যা, যা শিবের কৃপা লাভের উপায়। পদযাত্রার কষ্ট সহ্য করে ভক্তরা নিজেদের পাপ মোচনের আশায় এই ব্রত গ্রহণ করেন।

শ্রাবণ মাসে নিরামিষ আহার, সংযম, উপবাস স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য উপযোগী। এই সময় বর্ষাকাল, রোগের প্রকোপ বাড়ে। সংযম ও সতর্কতা জীবন সুস্থ রাখে। শিবের ধ্যান ও যোগ অভ্যাস এই মাসে অধিক ফলদায়ক, কারণ শিব স্বয়ং যোগেশ্বর।

“যোগী শঙ্কর, ধ্যানমগ্ন, সংসার ত্যাগী তুমি,
তোমার ধ্যানে মিলুক শান্তি, কাটুক পাপের ভুমি।
শ্রাবণেতে উপবাস করি, রাখি তোমার ধ্যান,
সারাজীবন কৃপা কোরো, দাও সৎজ্ঞান।।”

শ্রাবণ মাস প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত। এই সময় বৃক্ষরোপণ, নদী-পুকুর পরিষ্কার করা, পশুপাখির যত্ন নেওয়া পরিবেশ রক্ষার বার্তা বহন করে। শিব অরণ্যের দেবতা, তাই প্রকৃতিকে রক্ষা করাও শিবপূজার এক অঙ্গ।

শ্রাবণ মাস শিবের আরাধনার, আত্মশুদ্ধির, সংযমের, ধ্যান-তপস্যার মাস। এই মাসে শিবভক্তি করলে, জীবন থেকে অজ্ঞানতা, পাপ, কষ্ট দূর হয়। শিবের কৃপায় জীবন পায় নতুন দিশা।
“হর হর মহাদেব, নীলকণ্ঠ বিশ্বেশ,
শ্রাবণেতে ব্রত ধরি, করি তব আবেশ।
পুণ্য দাও, শান্তি দাও, মোক্ষের পথে ডাক,
শ্রাবণমাসে পূর্ণ হোক, শিবনামের শোভাক।।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *