
নিজস্ব সংবাদদাতা, জিয়াগঞ্জ (মুর্শিদাবাদ):
মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে যত রহস্যময় কাহিনি ছড়িয়ে আছে, তার মধ্যে অন্যতম হল জিয়াগঞ্জের আমাইপাড়ার ডাকাত কালী। প্রায় তিন শতাব্দী পেরিয়েও এই পূজো আজও সমান ভক্তিসহকারে পালিত হয়। একসময় যেই স্থানে ডাকাতেরা পণ নিয়ে পূজো করে ডাকাতিতে বেরোত, সেই স্থানেই এখন শোনা যায় ঢাকের শব্দ, প্রদীপের আলোয় ভাসে ভক্তির আবেশ। জানালেন জিয়াগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা অর্পণ সাহা।
এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি। ইতিহাস বলছে, যখন জিয়াগঞ্জ শহর ‘বালুচর’ নামে পরিচিত ছিল, তখন থেকেই নাকি মায়ের পূজো শুরু। তখনকার দিনে ডাকাত দলেরা রাত্রির অন্ধকারে এই ডাকাত কালী মায়ের কাছে পূজো দিয়ে যাত্রা করত। বলা হয়, তাঁরা বিশ্বাস করতেন— মায়ের আশীর্বাদেই তাঁদের লুণ্ঠন অভিযান সফল হত। সেই থেকেই দেবীর নাম হয় ডাকাত কালী।
একসময় এই পূজোয় নরবলি দেওয়ার প্রথাও চালু ছিল বলে জনশ্রুতি। মায়ের আসন প্রতিষ্ঠিত পঞ্চমুণ্ডের ওপর— সাপ, বেজি, শেয়াল, হনুমান ও মানুষের মুণ্ডের প্রতীকী প্রতিরূপে তৈরি হয়েছিল দেবীর বেদি। আজও সেই আসন অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয়রা বলেন, ‘‘যেভাবে ডাকাতরা রীতিমতো ভয়ংকর উপায়ে পূজো শুরু করেছিল, আজও সেই ঐতিহ্য মানা হয়, যদিও এখন তার ধর্মীয় রূপই কেবল অবশিষ্ট।’’
প্রথমদিকে এই পূজোর পুরোহিত ছিলেন কাশীনাথ নামে এক ব্রাহ্মণ। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বৃদ্ধা মা। তাঁদের উপাচার ছিল গঙ্গাজল, বেলপাতা ও জবা ফুল। কিন্তু কাশীনাথের অকালমৃত্যুর পর পূজো বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। কারণ, যারা পূজোর দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এসেছিল, তাদের পরিবারে নানাবিধ অঘটন ঘটেছিল। ভয়ে কেউ আর দায়িত্ব নিতে চায়নি।
তখনই সামনে আসেন ভট্টপাড়ার কৈলাসচন্দ্র ভট্টাচার্য। অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন— “মায়ের পূজো করতে গিয়ে যদি মৃত্যু হয়, সেটাই আমার পরম সৌভাগ্য।” আশ্চর্যের বিষয়, সেই বছর পূজো সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে শেষ হয় এবং কৈলাসবাবুর পরিবারে কোনও বিপদ আসে না।
এরপর থেকে ভট্টাচার্য পরিবারই এই পূজোর দায়িত্ব পালন করে আসছে। কৈলাসবাবুর মৃত্যুর পর দায়িত্ব নেন তাঁর পুত্র শ্রীশচন্দ্র ভট্টাচার্য, তারপর কালীকিঙ্কর ভট্টাচার্য, এবং বর্তমানে এই প্রাচীন ঐতিহ্যের ভার বহন করছেন শ্রী সুব্রত ভট্টাচার্য।
তবে শুধু পূজোর ঐতিহ্য নয়, আমাইপাড়ার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও এক অলৌকিক উপাখ্যান। বলা হয়, তিলিপাড়ার অবিনাশ চন্দ্র সাহা নামের এক রাত্রিকালীন প্রহরী প্রায়ই রাতে দেখতেন, লালপাড় সাদা শাড়ি পরা এক মহিলা কলসি হাতে গঙ্গার জল আনতে যাচ্ছেন। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো কোনো রক্ষণশীল পরিবারের গৃহবধূ। কিন্তু একদিন কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে তিনি তাঁর পিছু নেন। দেখা যায়, সেই মহিলা সরাসরি প্রবেশ করলেন কালীমাতার মন্দিরে। তখন অবশ্য মন্দিরটি ছিল টিনের চালা আর মাটির বেদিতে গঠিত। হঠাৎই ভিতর থেকে ভেসে আসে এক অজানা গম্ভীর স্বর—
“তুই যা দেখলি, কাউকে বলবি না। বললে তোর বংশ শেষ হয়ে যাবে।”
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অবিনাশবাবু বাড়ি ফিরে গেলেও, পরদিনই তিনি ঘটনাটি পরিবারে জানিয়ে দেন। এবং কয়েক দিনের মধ্যেই ঘটে তাঁর মৃত্যু। বলা হয়, তাঁর বংশেরও কেউ দীর্ঘায়ু পাননি। আজও স্থানীয়দের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় এই কাহিনি।
বর্তমানে মায়ের প্রতিমা প্রায় ১২ ফুট উচ্চতার— নিকষ কালো রঙের ভয়াল অথচ অপার শান্তিময় চেহারায় পূর্ণ। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, মুখে ক্রোধ ও করুণার মিশেল। ভক্তরা বলেন, “মায়ের সামনে দাঁড়ালেই একসঙ্গে ভয় আর ভক্তি দুটোই অনুভব হয়।”
প্রতিবছর কালীপুজোর সময় এই আমাইপাড়ার মন্দিরে ভক্তদের ঢল নামে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন শুধুমাত্র মায়ের দর্শনে। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, শত বছরের পুরনো এই পূজো শুধু ভক্তির প্রতীক নয়, জিয়াগঞ্জের এক জীবন্ত ইতিহাস।
আজও অন্ধকার নামলে, মন্দির প্রাঙ্গণে যখন জ্বলে ওঠে প্রদীপের আলো, আর বাতাসে ভেসে আসে ঢাকের তাল— মনে হয় যেন শতবর্ষ আগের সেই ডাকাতরাও ফিরে এসেছে মায়ের আশীর্বাদ নিতে।