
স্বর্গীয় চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের স্মরণে আয়োজন, ৩৬ জন শিল্পীকে সম্মাননা
নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা, ২৫আগস্ট:
২০১৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ওম স্বস্তি ফিল্মস–এর আয়োজিত ইন্দো বাংলা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। প্রথম বছর থেকেই কলকাতার চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শক ও শিল্পীদের কাছে এটি বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সিনেমাকে কেন্দ্র করে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল এই যাত্রা। সেই যাত্রা আজ এসে পৌঁছেছে এক যুগান্তকারী মুহূর্তে।
২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল শুধুমাত্র অফলাইনে। বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, পরিচালক–অভিনেতা–অভিনেত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানেই ভরে উঠেছিল সেই প্রথম চার বছর। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা লকডাউনের সময় বিশ্বজুড়ে সবকিছু যখন থমকে গিয়েছিল, তখনই এই চলচ্চিত্র উৎসব নতুন পথ দেখায়। ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করে ওম স্বস্তি ফিল্মস। সেই থেকে শুরু হয় উৎসবের নতুন অধ্যায়—যেখানে অনলাইন এবং অফলাইন মিলিয়ে চলতে থাকে প্রদর্শনী ও অনুষ্ঠান।
করোনা-পরবর্তী সময়ে যখন মানুষ ঘরবন্দি, তখন এই উদ্যোগই সিনেমাপ্রেমীদের এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা এনে দেয়। সিনেমার সঙ্গে দর্শকের সংযোগ বজায় রাখতে এই উৎসবই পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে।
শুরু থেকেই এই চলচ্চিত্র উৎসবের অন্যতম লক্ষ্য ছিল নতুন চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা ও শিল্পীদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। ওম স্বস্তি ফিল্মস–এর এই উদ্যোগ বহু তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন পূরণের পথ খুলে দিয়েছে। গত এক দশকে উৎসবটি থেকে বহু নতুন প্রতিভা উঠে এসেছে, যারা পরবর্তীতে নিজেদের জায়গা করে নিতে পেরেছেন চলচ্চিত্র দুনিয়ায়।
উৎসব কমিটির তরফে জানানো হয়েছে—“এটি কেবলমাত্র একটি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান নয়, বরং নতুনদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উদ্যোগ। গত এগারো বছরে অসংখ্য নতুন প্রতিভা এখানে সুযোগ পেয়েছেন। আমরা চাই আগামী দিনগুলোতে আরও বড় মাপের অনুষ্ঠান করে নতুন প্রজন্মের পাশে দাঁড়াতে।”
আসন্ন ৩১ আগস্ট ২০২৫ উৎসবের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন হতে চলেছে। স্বর্গীয় চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ–এর স্মরণে আয়োজিত হবে বিশেষ সম্মাননা অনুষ্ঠান। এই দিনে ঋতুপর্ণ ঘোষ স্মৃতি স্মারক প্রদান করা হবে ৩৬ জন খ্যাতনামা চলচ্চিত্র অভিনেতা–অভিনেত্রী এবং উদীয়মান শিল্পীদের।
ঋতুপর্ণ ঘোষ বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর চলচ্চিত্র শুধুমাত্র বিনোদন নয়, সামাজিক বার্তা এবং মানবিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছিল। তাঁর নামাঙ্কিত এই স্মৃতি সম্মান দেওয়া হবে সেইসব শিল্পীদের, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে অভিনয় ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অবদান রেখে চলেছেন অথবা নতুন প্রজন্মের শিল্পী হিসেবে আলো ছড়াচ্ছেন।
৩১ আগস্টের এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে বিশেষ উত্তেজনা। উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ওইদিন উপস্থিত থাকবেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। একই সঙ্গে থাকবেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী সান্তনা বসু এবং এই চলচ্চিত্র উৎসবে সভাপতিত্ব করছেন অরুনিমা চ্যাটার্জি আরও বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পী।
আয়োজকদের মতে, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতি এই উৎসবকে এক বিশেষ মর্যাদা এনে দেবে। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় রচনা করেছেন। তাই তাঁর হাতে পুরস্কার গ্রহণ করা নতুন শিল্পীদের জন্য হবে গর্বের মুহূর্ত।
এবারে উৎসবের ১১তম আসর বসছে। এক দশকের বেশি সময় অতিক্রম করার পরও উৎসবটি ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। দর্শক, শিল্পী ও নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে—“এটি আমাদের কাছে শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, বরং একধরনের সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ভবিষ্যতে আমরা চাই আরও বড় মাপের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করতে।”
তাঁরা আরও আশা প্রকাশ করেছেন, আগামী দিনে এই চলচ্চিত্র উৎসব বাংলা চলচ্চিত্রকে আরও আন্তর্জাতিক পরিসরে পৌঁছে দেবে। শুধু পুরোনো প্রজন্ম নয়, নতুন প্রজন্মকেও এই উৎসব ঘিরে একত্রিত করা হবে।
চলচ্চিত্র শুধুমাত্র বিনোদন নয়, এটি সমাজের প্রতিচ্ছবি—এই বিশ্বাস নিয়েই ইন্দো বাংলা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এগিয়ে চলেছে। প্রতি বছরই সমাজ, সংস্কৃতি এবং মানুষের জীবনযাত্রার নানা দিককে কেন্দ্র করে নানা ধরণের চলচ্চিত্র এখানে প্রদর্শিত হয়। দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তের চলচ্চিত্র নির্মাতারা এখানে অংশ নেন।
২০২৬ সালের এই আসরেও দর্শক দেখতে পাবেন একাধিক ভিন্নধর্মী ছবি। থাকবে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা এবং ডকুমেন্টারি। আয়োজকদের আশা, এবার আরও বড় পরিসরে হবে প্রদর্শনী।
২০১৭ সালে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ছোট্ট পদক্ষেপে, আজ তা এগিয়ে এসেছে এক দীর্ঘ পথ পেরিয়ে। অনলাইন ও অফলাইনের সমন্বয়ে আজ এই চলচ্চিত্র উৎসব শুধুমাত্র কলকাতার নয়, ভারতের অন্যতম বড় উৎসব হয়ে উঠেছে।
আগামী ৩১ আগস্ট ২০২৫–এর বিশেষ দিনটি তাই শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, বরং বাংলা চলচ্চিত্রের প্রতি সম্মান জানানোর দিন। ঋতুপর্ণ ঘোষের স্মৃতিকে সামনে রেখে ৩৬ জন শিল্পীর হাতে যখন সম্মাননা তুলে দেওয়া হবে, তখন আবার প্রমাণিত হবে—চলচ্চিত্র আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।