ঝুলন লীলা ভারতীয় বৈদিক সাহিত্যে শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণের ঝুলনলীলা বা হিন্দোল লীলা এক বিশেষ প্রচলিত আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান।

Spread the love

ভারতীয় বৈদিক সাহিত্যে শ্রীশ্রী রাধাকৃষ্ণের ঝুলনলীলা বা হিন্দোল লীলা এক বিশেষ প্রচলিত আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। শ্রীকৃষ্ণ মাধুর্যময়ী লীলারস আস্বাদনের জন্য এবং তাঁর ভক্তগনের আনন্দ প্রদানের জন্য তিনি লীলা বিগ্রহ রূপ ধারণ করেন। অখিল ব্রহ্মান্ড পতি নিত্য নব নব লীলা রসিক শ্রীকৃষ্ণের যখন যে লীলার সংকল্প হয়, তখনই তাঁর লীলাশক্তি সেই ভাবে তাঁর লীলাক্ষেত্র ও তাঁর লীলা সঙ্গীগনকে বিভাবিত করেন। সুখময় বৃন্দাবন ভূমিতে যদিও নিত্য বসন্ত ঋতুর প্রকাশ থাকে, তথাপিও অন্যান্য ঋতু সকল শ্রীকৃষ্ণের সেবার সুযোগ গ্রহণ করেন। তাই লীলা রসিক শ্রীকৃষ্ণের জল বিহার, বন বিহারাদি নানা প্রকার গ্রীষ্মকালীন লীলার সেবা করে লীলাভূমি বৃন্দাবন হতে গ্রীষ্ম ঋতু বিদায় গ্রহণ করেন। তখন শ্রীকৃষ্ণের বর্ষ বিহারের সংকল্প বুঝে তাঁর লীলা শক্তি বর্ষার আগম ঘটিয়ে বৃন্দাবনের বনভূমি, বৃক্ষলতা, পশুপাখি, তথা তাঁর লীলাক্ষেত্র এবং তাঁর লীলা সঙ্গীগনকে এমন ভাবে ভাবিত ও সজ্জিত করেন যে সকলেই শ্রীকৃষ্ণের বর্ষা বিহারের তথা হিন্দোল লীলা বা ঝুলন লীলা বিহারের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।

আনন্দ প্রয়াসী কোন প্রমোদিত রাজা তাঁর পরিকর সহ ক্রীড়ারস আস্বাদন করে পরিশ্রান্ত হলে যেমন তাঁর বিশ্রাম কক্ষের অলিন্দ পথে ঝুলনায় আরোহন করে মৃদু-মন্দভাবে দুলতে থাকেন এবং তার সেবকগন চামর – ব্যজনাদি দ্বারা সেবা করেন এবং পানক তাম্বুলাদি প্রদান পূর্বক যে ভাবে প্রচুর আনন্দ লাভ করেন, তদ্রুপ শ্রীবৃন্দাবন নায়ক শ্রীকৃষ্ণ গ্রীষ্মকালীন লীলা বিহারাদিতে পরিশ্রান্ত হয়েছেন মনে করে শ্রীকৃষ্ণের লীলা শক্তির নির্দেশে বর্ষা ঋতু যেন শীতল বায়ু সূক্ষ বৃষ্টি কনাদি সহ সেবক রূপে বৃন্দাবনে এসে যথাযোগ্য পরিকর সহ হিন্দোল লীলা বা ঝুলন লীলার সেবায় মগ্ন হলেন। শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণের ঝুলন যাত্রা বা হিন্দোল লীলা মহোৎসব বৈষ্ণব সমাজে এক বিশেষ পরমাকর্ষনীয় অনুষ্ঠান। শ্রী ব্রজমন্ডলে শ্রাবণী শুক্লা তৃতীয়া হতে শ্রাবণী রাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই ঝুলন লীলার অনুষ্ঠান চলতে থাকে।
গ্রীষ্মকালীন প্রচন্ড সূর্যতাপে বৃন্দাবনের তরুলতাদি শুষ্ক প্রায় এবং পশুপাখি প্রায় মিয়মান হয়ে থাকে। বর্ষা ঋতুর শুভাগমনে মেঘমুক্ত বর্ষার নববর্ষ সম্পাতে বৃক্ষলতাদি সজীব ও নবপল্লবাদি ধারণ করে এক অভিনব মনোমুগ্ধকর সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি করে। বর্ষা ঋতুজাত যুথিকা, কদম্ব, কেতকী, রজনী নানা পুষ্পরাজি বনভূমিকে অলঙ্কৃত করছে। আকাশে মৃদু মৃদু গর্জন আর হালকা বৃষ্টি পতনে শিথিকুল পাখা বিস্তার করে কেকা ধ্বনি করতে করতে পরম সুখে নৃত্য করছে। আর বিভিন্ন পাখির কলকূজনে বনভূমি মুখরিত। গগন মন্ডল মেঘমালায় আবৃত করে অবিরত বারিধারা বর্ষন করছে। এই প্রকার মনোমুগ্ধকর বনশোভা দর্শন করে ঝুলনলীলা আমোদী ভক্তগণ শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণকে বর্ষা ঋতুর “প্রীতি উপহার” হিন্দোল লীলা বা ঝুলনলীলার অনুষ্ঠানের জন্য উৎফুল্লিত হয়ে থাকেন। শ্রীব্রজ বৃন্দাবনে শ্রাবণী শুক্লা তৃতীয়া হতে শ্রাবণী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই ঝুলন লীলার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

বৃন্দাবনের ন্যায় বঙ্গভূমিতেও শ্রাবণী শুক্লা একাদশী হতে শ্রাবণী রাখী পূর্ণিমা পর্যন্ত ব্রজ-বৃন্দাবনের ঝুলন লীলার ভাবোদ্দীপনে ঝুলন লীলার স্মৃতি চারন পূর্বক বঙ্গভূমির বিভিন্ন মঠ-মন্দিরে, শ্রীপাটে, হরিসভায়, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনে এই ঝুলনলীলার অনুষ্ঠান মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাংলা ভাষায় বহু বৈষ্ণব পদকর্তা ঝুলন বিষয়ক রচনা করেছেন। যেমন- গোবিন্দ দাস, বৈষ্ণব দাস, জগন্নাথ দাস, রাষ্ট্রমোহন ঠাকুর, রায় শেখর প্রমুখ পদকর্তাগন। রায় শেখরের ঝুলন পদের দৃষ্টান্ত, যথা-

” কানন দেবতী

বৃন্দা সখী তিনি

রাইয়ের সরসী কূলে।

বিচিত্র ঝুলনা

করিল রচনা

সুখদ বকুল মূলে।।

ঝুলনা উপরি

নাগর নাগরী

আসিয়া বসিল রঙ্গে।

ঝুলায় ঝুলনা

সকল ললনা

ভাবে গদগদ্ অঙ্গে।।

এই ঝুলন লীলা বা হিন্দোল লীলার অনুষ্ঠান বাঙালী সংস্কৃতির বিশেষ পরিচয় প্রদান করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *