গুরু পূর্ণিমা: জ্ঞান, শ্রদ্ধা ও আত্মোন্নতির এক অনন্য উৎসব

Spread the love

প্রতি বছর আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় গুরু পূর্ণিমা—ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রাচীন ও পবিত্র উৎসব। এই দিনটি শুধুমাত্র ধর্মীয় বা আচারগত অনুষ্ঠান নয়, এটি জ্ঞান, শিক্ষা, শিষ্যত্ব ও গুরুতত্ত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শনের দিন। গুরু পূর্ণিমা এমন একটি দিন, যেদিন শিষ্যরা তাদের শিক্ষাগুরু, আধ্যাত্মিক গুরু বা জীবনের পথপ্রদর্শকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে

“গু” মানে অন্ধকার, “রু” মানে যিনি অন্ধকার দূর করেন। গুরু হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি জ্ঞান ও আত্মদর্শনের মাধ্যমে জীবনের অন্ধকার দূর করেন। তিনি কেবল বিদ্যা বা পড়াশোনার শিক্ষা দেন না, তিনি শিষ্যের চরিত্র, মন, আত্মা ও নৈতিকতাকে গঠিত করেন।

ভারতীয় দর্শনে গুরুকে ঈশ্বরের তুল্য বলা হয়েছে। “গুরুব্রহ্মা, গুরুবিষ্ণু, গুরুদেবো মহেশ্বরঃ…”—এই শ্লোকটি গুরুর মর্যাদা ও শক্তিকে তুলে ধরে।

গুরু পূর্ণিমার উৎস বহু প্রাচীন। এটি নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। কিছু উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ভিত্তি:

বেদব্যাসের পূজা: এই দিনে মহর্ষি বেদব্যাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি মহাভারতের রচয়িতা এবং বেদ-উপনিষদ সংকলনকারী ছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গুরু পূর্ণিমার দিনকে “ব্যাস পূর্ণিমা”ও বলা হয়।

বুদ্ধদেব ও গুরু পূর্ণিমা: বৌদ্ধ মতে, এই দিনেই গৌতম বুদ্ধ বোধিলাভের পরে প্রথম ধর্মদেশনা দেন বেনারসের সারনাথে। সেই কারণে বৌদ্ধরাও গুরু পূর্ণিমা উদযাপন করে।
জৈন ধর্মে গুরু পূর্ণিমা: জৈন মতে, এই দিনে মহাবীরের প্রথম শিষ্য গৌতম স্বামী দীক্ষা গ্রহণ করেন।
হিন্দুধর্মে গুরু পূর্ণিমা হল সেই দিন, যেদিন শিষ্যরা তাদের গুরুর পায়ে প্রণাম করে, গুরুদক্ষিণা প্রদান করে এবং আশীর্বাদ গ্রহণ করে। প্রাচীন ভারতের গুরু-শিষ্য পরম্পরায় আশ্রমিক শিক্ষা ছিল মূল ভিত্তি। সেই ধারাকে স্মরণ করতেই এই পূর্ণিমা।

রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদ—সবখানেই গুরুর মর্যাদা সর্বোচ্চ। শ্রদ্ধা, অনুশাসন, আত্মনিবেদন—এই তিনিই গুরুর প্রতি আদর্শ

আধুনিক যুগে গুরু পূর্ণিমার প্রাসঙ্গিকতা

বর্তমানে শিক্ষা ও যোগাযোগ মাধ্যম বদলেছে, কিন্তু গুরুর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব কমেনি। আজকের দিনে গুরু শুধু বিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষক নন, জীবনের প্রতিটি স্তরে যিনি আমাদের পথ দেখান, তিনি-ই গুরু।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ গুরু পূর্ণিমায় তাঁদের শিক্ষক, আধ্যাত্মিক নেতা, এমনকি মা-বাবার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
আশ্রম ও মঠে পূজা: গুরুদের পাদপূজা, আরতি, ভজন ও গুরু-উপদেশের আয়োজন হয়।

বিদ্যালয়ে: শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রদ্ধা বিনিময়ের নানা আয়োজন হয়।

আধ্যাত্মিক কেন্দ্রে: গুরুদের মহিমা ও দর্শনের আলোচনাসভা হয়।
শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, গুরু জীবনের প্রকৃত অর্থ শেখান। আত্মনিয়ন্ত্রণ, করুণা, ধৈর্য, এবং আত্মজ্ঞান অর্জনের পথে গুরু পথপ্রদর্শক। অনেক সময় গুরু জীবনের এমন কিছু কথা বলেন যা আমাদের চিরকাল পথ দেখায়।

গুরু পূর্ণিমা শুধুমাত্র একটি আচার বা ঐতিহ্য নয়, এটি একজন মানুষের জীবনে ‘জ্ঞানের আলো’ জ্বালানোর এক মহান উপলক্ষ। এই দিনে গুরুকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ ও সম্মান জানানো মানে জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও পথ খোঁজা। যাঁর আশীর্বাদে আমরা নিজের ভিতরকার সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করি, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ দিন—গুরু পূর্ণিমা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *