🎙️ কিশোর কুমার: এক বহুমুখী প্রতিভার জীবনকথা

কিশোর কুমার, আসল নাম অভাষ কুমার গাঙ্গুলি, জন্মগ্রহণ করেন ৪ আগস্ট ১৯২৯ সালে মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডওয়া শহরে। তার পিতা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি ছিলেন একজন আইনজীবী এবং মা গৌরী দেবী ছিলেন গৃহিণী। কিশোর ছিলেন চার ভাই-বোনের মধ্যে কনিষ্ঠ। তার বড় ভাই অশোক কুমার এবং অনুপ কুমার উভয়েই ছিলেন নামকরা চলচ্চিত্র অভিনেতা।

ছোটবেলা থেকেই কিশোর কুমার গান ও অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তবে তার স্বপ্ন ছিল গায়ক হওয়ার, যদিও জীবনের শুরুতে তার গায়ক হওয়ার পথটা খুব সহজ ছিল না। বাড়ির ভাষা বাংলা হলেও, তিনি বহু ভাষায় গান গেয়ে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেন।

তার বড় ভাই অশোক কুমার তখন বোম্বে টকিজে প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা। তার উৎসাহেই কিশোর কুমার মুম্বাইয়ে আসেন। প্রথমদিকে তিনি গান গাওয়ার জন্য নয়, বরং অভিনেতা হিসেবে ফিল্মে আসেন। ১৯৪৬ সালে “শিকারি” ছবিতে ছোট একটি ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন।
যদিও শুরুতে কেউ তাকে গায়ক হিসেবে গুরুত্ব দিত না, তিনি নিজে নিজেই রেওয়াজ করতেন কুন্দনলাল সায়গলের গান শুনে। সায়গলকে তিনি গুরু বলে মানতেন। ১৯৫১ সালে “আন্দোলন” সিনেমায় প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ পান, তবে “আড়ি আড়ি আমি প্রেমে প’ড়ি” (ফিল্ম: “লাদকি”) গানটি তাকে পরিচিতি এনে দেয়।

তার কণ্ঠের স্বতন্ত্রতা, হাস্যরস, আবেগ, মেজাজ অনুযায়ী সুরের ওঠা-নামা তাকে অদ্বিতীয় করে তোলে। কিশোর কুমার এমন এক গায়ক যিনি হাসির গান, দুঃখের গান, রোমান্টিক গান, দার্শনিক গান—সব ধারাতেই সমান
পারদর্শী ছিলেন।
১৯৫০-এর দশকের শেষ দিক থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত ছিল কিশোর কুমারের কর্মজীবনের স্বর্ণযুগ। তিনি রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, জিতেন্দ্র, দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র প্রমুখ অভিনেতার কণ্ঠস্বর হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

বিশেষ করে এস. ডি. বর্মণ, রাহুল দেব বর্মণ (আর. ডি. বর্মণ), লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল, কাল্যাণজী-আনন্দজী, বাপ্পি লাহিড়ীর সাথে তার যুগলবন্দি সংগীতপ্রেমীদের হৃদয় জয় করে।

তার কিছু কালজয়ী গান:

“পল পল দিল কে পাশে”

“কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা”

“কিছু তো লোগ কহেঙ্গে”

“জিন্দগী এক সফর হ্যায় সুহানা”

“মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে”

“ইয়ে শাম মস্তানি”

শুধু গায়কই নয়, কিশোর কুমার ছিলেন একজন সফল চিত্রপরিচালক ও প্রযোজক। তার পরিচালিত ছবিগুলোর মধ্যে “দূর গগন কি ছাঁও মেঁ”, “দূর ка রাহি”, এবং “হুম দুই আমাদের” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি নিজের ছবিগুলোতে অভিনয়ও করতেন।

তিনি ছিলেন ভীষণভাবে স্বাধীনচেতা এবং প্রচলিত নিয়ম মানতে চাইতেন না। এই স্বভাবের জন্য তাকে বহুবার প্রযোজক ও পরিচালকদের রোষানলে পড়তে হয়েছে।
কিশোর কুমারের ব্যক্তিগত জীবন ছিল ঘটনাবহুল ও বিতর্কিত। তিনি চারবার বিয়ে করেন।

1. প্রথম স্ত্রী – রূমা গুহ ঠাকুরতা (১৯৫০–১৯৫৮), যিনি ছিলেন একজন বাঙালি গায়িকা ও অভিনেত্রী। তাদের একটি সন্তান হয়।
2. দ্বিতীয় স্ত্রী – মধুবালা (১৯৬০–১৯৬৯), বলিউডের কিংবদন্তি অভিনেত্রী। মধুবালার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক ছিল। যদিও ধর্ম ও স্বাস্থ্যজনিত কারণে এই সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়েছিল।
3. তৃতীয় স্ত্রী – যোগিতা বালি (১৯৭৬–১৯৭৮), এই সম্পর্কও বেশিদিন টিকেনি।
4. চতুর্থ স্ত্রী – লীনা চন্দ্রাভরকর (১৯৮০–১৯৮৭), তিনিই ছিলেন কিশোর কুমারের শেষ জীবনসঙ্গিনী।
   তার একমাত্র সন্তান অমিত কুমার, যিনি নিজেও একজন নামকরা গায়ক এবং তার পিতার সঙ্গেও বহু গানে কণ্ঠ মিলিয়েছেন।

কিশোর কুমার ছিলেন এক আজব চরিত্র। তিনি কখনো প্রযোজকদের থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতেন, আবার কখনো বাড়ির দরজায় “Beware of Kishore” লিখে রাখতেন। কেউ বললে যে তিনি গলায় সায়গলের অনুকরণ করছেন, কিশোর তখন জেদ করে উল্টোপাল্টা গান গাইতেন।

অভিনয়েও তিনি ছিলেন অনবদ্য – তার কমিক টাইমিং, অভিব্যক্তি ও অদ্ভুত স্বভাব দর্শকদের মনোরঞ্জন করত।

১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। তার কণ্ঠে আগের মতো জোর না থাকলেও, প্রেম ও বেদনার গভীরতায় তার গান তখনো মানুষের হৃদয়ে দোলা দিত।

১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৫৮ বছর বয়সে কিশোর কুমার পরলোকগমন করেন। মৃত্যুর আগের দিনও তিনি গান রেকর্ড করছিলেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, তাকে তার জন্মস্থান খাণ্ডওয়ায় সমাধিস্থ করা হয়।

কিশোর কুমার শুধুই একজন গায়ক ছিলেন না – তিনি ছিলেন এক বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী: গায়ক, অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক, কাহিনি রচয়িতা এবং জীবনের শিল্পী। তার গান আজও কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে বাজে। তিনি নিজেই বলেছিলেন:
“Main pagal hoon, lekin mera paagalpan hi meri pehchaan hai.”

আজও তার গান নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে বেঁচে থাকে – তিনি অমর, কিংবদন্তি।

কিশোর কুমার ছিলেন এক যুগসন্ধি পুরুষ – যিনি সংগীত ও সিনেমার জগতে নিত্যনতুন ধারা এনেছিলেন। জীবনের হাসি, কান্না, প্রেম ও বেদনার সুরে তিনি আমাদের হৃদয়ে থেকে যাবেন চিরকাল। তাঁর জীবনী যেন এক সংগীতময় উপন্যাস, যেখানে প্রতিটি অধ্যায়ে সুর বাজে।