চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন চলচ্চিত্রের অধ্যায় কলমে- শ্রী দাস

Spread the love

বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রে মৃণাল সেন এক অতুলনীয় নাম। তার চলচ্চিত্র কেবল বিনোদনের বাহন নয়, বরং সমাজের গভীর অসংগতিগুলিকে তুলে ধরার এক শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ২০০২ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর নির্মিত ছবির মাধ্যমে দর্শককে শুধুমাত্র কাহিনির জগতে নিয়ে যাননি, বরং চিন্তার গভীরতায় প্রবেশ করিয়েছেন। তার জীবন ও কর্ম এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রইল, যেখানে শিল্প, রাজনীতি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা এক অপূর্ব মিশ্রণে গাঁথা।

মৃণাল সেন জন্মগ্রহণ করেন ১৪ মে ১৯২৩ সালে, ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরে (বর্তমানে বাংলাদেশে)। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে ওঠা মৃণালের শৈশব কেটেছে এক সাধারণ পরিবেশে। পড়াশোনায় তিনি ছিলেন মেধাবী এবং সংস্কৃতির প্রতি ছিল গভীর টান। ফরিদপুরে প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন উচ্চশিক্ষার জন্য।

কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানেই তার চিন্তাধারায় পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। তিনি মার্কসবাদী দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সেই চিন্তাধারাই পরবর্তীকালে তার চলচ্চিত্র নির্মাণে গভীর প্রভাব ফেলে।

চলচ্চিত্রে তার সরাসরি প্রবেশ ঘটে অনিয়মিতভাবে। তিনি প্রথমে একটি মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি করতেন, পরে কিছু সময় সাংবাদিকতাও করেন। এই সময়ে তিনি কলকাতার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক মহলের সাথে জড়িয়ে পড়েন। প্রগতিশীল লেখক শিল্পীদের সঙ্গে মেলামেশা তার মননশীলতাকে আরও তীক্ষ্ণ করে তোলে। যদিও মৃণাল কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য হননি, তবে তার চলচ্চিত্রে স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক ও সমাজ-সচেতন বার্তা ছিল।

চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহ জন্মায় একসময় আত্মচিন্তার মাধ্যমে। চলচ্চিত্র তার কাছে হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত ও সামাজিক মত প্রকাশের এক অসাধারণ মাধ্যম। তিনি পড়াশোনা করতে থাকেন সিনেমার ভাষা, এডিটিং, দৃশ্যায়ন ও অন্যান্য কারিগরি দিক নিয়ে। এর পাশাপাশি তিনি ইতালির ‘নিও-রিয়ালিজম’ ধারার প্রভাবিত হন এবং তার চলচ্চিত্রে এর ছাপ পরিলক্ষিত হয়।

১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম ছবি ‘রাতভোর’, যা সেসময় তেমন বাণিজ্যিক বা সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। তবে এই ছবি দিয়েই মৃণাল সিনেমা জগতে আত্মপ্রকাশ করেন।

তার প্রকৃত সাফল্য আসে ১৯৫৮ সালে ‘নীল আকাশের নিচে’ ছবির মাধ্যমে। এই ছবিতে তিনি উপনিবেশবাদ, মানবতা এবং বন্ধুত্বের জটিল মনস্তত্ত্ব তুলে ধরেন। এরপর ১৯৬৯ সালে ‘ভুবন সোম’ ছবির মাধ্যমে তিনি জাতীয় স্তরে স্বীকৃতি অর্জন করেন। এই ছবি আধুনিক ভারতীয় সিনেমার এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। ছবিতে তথাকথিত সরকারি আমলাতন্ত্র এবং ক্ষমতার ভেতরের দোদুল্যমানতাকে ব্যঙ্গাত্মক ও সংবেদনশীল দৃষ্টিতে উপস্থাপন করা হয়।

১৯৭০-এর দশকে মৃণাল সেন এমন এক সময় ছবি বানাতে শুরু করেন, যখন ভারত রাজনৈতিকভাবে অস্থির সময় পার করছিল। পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলনের উত্তাল পরিবেশ এবং যুব সমাজের হতাশা তার সিনেমার মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে। তার ‘কলকাতা ট্রিলজি’—ইন্টারভিউ (1971), কলকাতা ৭১ (1972), এবং পদাতিক (1973)—তিনটি ছবিই এই সময়কার রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়।

এই ছবিগুলোর মাধ্যমে মৃণাল উঠে আসা মধ্যবিত্ত যুব সমাজের দোলাচল, আশা-নিরাশা এবং রাজনৈতিক বিভ্রান্তিকে সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেন। তার সিনেমায় কখনোই সরল সমাধান থাকতো না, বরং দর্শককে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতেন।

মৃণাল সেন কেবল বিষয়বস্তুর দিক থেকে নয়, চলচ্চিত্রের ভাষাগত দিক থেকেও নতুনত্ব এনেছেন। তার অনেক ছবিতে সময়, স্থান ও বাস্তবতার সঙ্গে খেলা করার এক অভিনব ধরন দেখা যায়। ‘খারিজ’ (1982), ‘একদিন প্রত্যেকদিন’ (1979), এবং ‘আকালের সন্ধানে’ (1980)-র মতো ছবিতে তিনি সমাজের শ্রেণি বৈষম্য ও মূল্যবোধের সংকট তুলে ধরেন।

তার ছবিতে এক ধরনের ‘ব্রেখটিয়ান এলিয়েনেশন’ বা বিচ্ছিন্নতার কৌশল দেখা যায়, যেখানে দর্শক সিনেমায় এতটা ডুবে না গিয়ে বরং সচেতনভাবে ভাবতে বাধ্য হয়। এটাই তার সিনেমার অনন্য বৈশিষ্ট্য।

মৃণাল সেন ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, এবং আন্তর্জাতিক বহু চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছেন। তার সিনেমা কান, বার্লিন, মস্কো, এবং ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়। ২০০৫ সালে তিনি ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’ অর্জন করেন, যা ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মান। এছাড়া ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে।

মৃণাল সেনের ব্যক্তিগত জীবন ছিল শান্ত ও নিঃসংকট। তার স্ত্রী গীতার সঙ্গে দীর্ঘ দাম্পত্যজীবন ছিল। তাঁদের একমাত্র পুত্র কুণাল সেন পেশায় একজন বিজ্ঞানী, যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন

২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আমার ভুবন’ ছিল তার শেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এরপর তিনি নিজেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে সরিয়ে আনেন। তবে তার চিন্তা, লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি সমাজ ও শিল্প সম্পর্কে মত প্রকাশ করতে থাকেন।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তাঁর ৯৫তম জন্মদিনটি নানা ভাবে পালন করা হয়। কিন্তু এর ঠিক এক বছর পর, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে, কলকাতায় তিনি পরলোক গমন করেন। তার মৃত্যুতে চলচ্চিত্র জগৎ এক মহান চিন্তকের অপূরণীয় ক্ষতিতে পড়েছিল।

মৃণাল সেন ছিলেন শুধুমাত্র একজন পরিচালক নন, তিনি ছিলেন সমাজের আয়না। তার সিনেমা শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং সমাজের দার্শনিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। যেভাবে তিনি মধ্যবিত্ত সমাজের মনস্তত্ত্ব, গরিব মানুষের বঞ্চনা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন, তা এক কথায় অনন্য।

আজও যখন কেউ ‘ভুবন সোম’, ‘আকালের সন্ধানে’, অথবা ‘কলকাতা ৭১’ দেখে, তখন শুধু একটি ছবি দেখে না—দেখে সময়, সমাজ এবং তার ভেতরের প্রশ্নগুলো। মৃণাল সেনের উত্তরাধিকার কেবল চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নয়, বরং মানবিক ও সমাজ-সচেতন চেতনাবোধে অমলিন হয়ে থাকবে চিরকাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *