অক্ষয় আশীর্বাদকলমে : শ্রী দাস

Spread the love

শান্তিপুর গ্রামের প্রান্তে ছিল ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর, যেখানে বাস করত বৃদ্ধা বাসন্তী। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে সে একাই ছিল। নিজের ছোট্ট উঠোনে শাকসবজি ফলিয়ে, দুই গরু পালিয়ে, ও গ্রামের ছোট বাচ্চাদের কড়িচানাচিনির কাজ শিখিয়ে কোনোভাবে দিন কাটাত।

অন্যদিকে, শহর থেকে সদ্য গ্রামে এসেছিল অনির্বাণ নামের এক তরুণ, গবেষণার কাজে। প্রাচীন বাংলার লোকাচার, উৎসব এবং সংস্কৃতি নিয়ে তার গভীর আগ্রহ ছিল। সে জানতে চেয়েছিল—“অক্ষয় তৃতীয়া” নামের এই দিনটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

একদিন সে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেল বাসন্তীর বাড়ি। চুলে রূপোর ছটা, চোখে শান্ত আলো, মুখে মায়াবী হাসি—বাসন্তী বলল, “এসো বাবা, এক কাপ চা দিই। আজ অক্ষয় তৃতীয়া, শুভ দিন।”

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অনির্বাণ জিজ্ঞেস করল, “ঠাকুমা, এই অক্ষয় তৃতীয়া দিনটা কি শুধুই শুভ দিন হিসেবে দেখা হয়? এর পেছনে কি কোনো কাহিনি আছে?”

বাসন্তী একটু হাসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন—

“অনেক বছর আগে, এই গ্রামে খরা পড়েছিল। ফসল নেই, জল নেই, খাবার নেই। গ্রামের মানুষ হাহাকার করছে। তখন এক বৃদ্ধা—সে ছিল খুব গরিব, কিন্তু তার ছিল এক আশ্চর্য বিশ্বাস—সে নিজের শেষ মুঠো চাল দিয়ে ভগবানকে খিচুড়ি রান্না করে নিবেদন করল। সেই দিন ছিল বৈশাখ মাসের তৃতীয়া তিথি।

বলে বিশ্বাস কর, সেই দিন থেকেই আকাশে মেঘ জমে এল, বৃষ্টি নামল, মাঠে আবার ফসল ফলল। সেই দিন থেকেই এই তিথিকে বলা হয় ‘অক্ষয়’—যার ক্ষয় নেই।”

অনির্বাণ অবাক হয়ে বলল, “এটা তো অসাধারণ কাহিনি! তবে শুধু কৃষির জন্যই?”

বাসন্তী বলল, “না রে বাবা, আরও অনেক কিছু আছে। এই দিনেই সত্যযুগ শুরু হয়েছিল বলে শোনা যায়। এই দিনে কুবের লক্ষ্মীকে আরাধনা করলে ধন-সম্পদ অক্ষয় থাকে। আবার এই দিনেই কৃষ্ণ বন্ধু সুধাময় দ্রৌপদীর জন্য অক্ষয়পাত্র দিয়েছিলেন, যাতে খাবার কখনও ফুরোয় না। পাণ্ডবদের বনবাসের সময় সেই পাত্রই ছিল তাদের আশা।”

“অর্থাৎ, বিশ্বাস, দান আর শুভ কাজের প্রতীক এই তিথি?”

“ঠিক তাই,” বাসন্তী মাথা নাড়লেন, “এই দিন মানুষ নতুন কাজ শুরু করে, সোনা কেনে, চাষ শুরু করে। বিশ্বাস করে, আজ যা শুরু হবে তা চিরস্থায়ী হবে, ক্ষয় হবে না।”

অনির্বাণ সেই গল্প শুনে মুগ্ধ হয়ে উঠল। সে ভাবল, শহরে তো কেবল সোনা কেনা, শপিং আর ব্যবসার হিসেব নিয়েই এই দিন কাটে। অথচ গ্রামে এই দিনের পেছনে আছে কত ইতিহাস, কত বিশ্বাস।

সেদিন সন্ধ্যায় বাসন্তী এক পাত্র খিচুড়ি রান্না করে অনির্বাণকে দিলেন। বললেন, “এই খিচুড়ি অক্ষয় আশীর্বাদের প্রতীক, এটা খাও, যাতে তোমার জ্ঞানের পথেও অক্ষয় আলো থাকে।”

অনির্বাণ হাতে পাত্র নিয়ে একটুকরো গ্রাম, ইতিহাস আর সংস্কৃতিকে নিজের হৃদয়ে নিয়ে ফিরে গেল। তার গবেষণাপত্রের প্রথম লাইনেই সে লিখল—“অক্ষয় তৃতীয়া শুধুই একটি শুভ দিন নয়, এটি বিশ্বাসের, দানের, এবং মানুষের অটুট আশার প্রতীক।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *