
কলকাতার এক বনেদি পরিবারে ১৯২১ সালের ২রা মে জন্মেছিলেন সত্যজিৎ রায়। বাবা সুকুমার রায় ছিলেন শিশু সাহিত্যের একজন কিংবদন্তি, আর দাদু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন একাধারে লেখক, চিত্রশিল্পী ও মুদ্রণবিদ। সত্যজিতের ছোটবেলাই বাবাকে হারিয়ে পরিবারে আর্থিক সঙ্কট নেমে আসে, কিন্তু সেই অভাব তাঁকে থামাতে পারেনি।
বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতনে পড়াকালীন তিনি রাভি শঙ্কর, নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতো মহান শিল্পীদের সংস্পর্শে আসেন। সেখানেই তার শিল্পচর্চার ভিত গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরি করার সময় তাঁর নকশা ও চিত্রশৈলীর প্রতি আগ্রহ আরও গভীর হয়।

১৯৫০ সালে প্যারিসে গিয়ে জঁ রেনোয়ার সঙ্গে দেখা হয়। এরপর ‘লাদ্রি বাইসাইক্লেত্তে’ দেখে তিনি অনুভব করেন—এমন চলচ্চিত্রই তিনি বানাতে চান। সেই অনুপ্রেরণাতেই জন্ম নেয় ‘পথের পাঁচালী’। কিন্তু অর্থের অভাবে সেই ছবি আটকে যায় বহুবার। নিজের জমানো টাকা, বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে, এমনকি গয়না বিক্রি করেও কাজ চালিয়ে যেতে হয়। অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাহায্যে ১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় ‘পথের পাঁচালী’—যা শুধুমাত্র বাংলা নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়।
তারপর ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’—অপুর ট্রিলজি বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়োয়। কান, ভেনিস, বার্লিন—সত্যজিতের ছবির আন্তর্জাতিক যাত্রা শুরু হয়। তিনি শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না; ছিলেন চিত্রকর, লেখক, সঙ্গীত পরিচালক এবং টাইপোগ্রাফির জনকও। তাঁর ‘ফেলুদা’, ‘প্রফেসর শঙ্কু’ চরিত্রগুলি আজও সমান জনপ্রিয়।
কিন্তু সাফল্যের এই পথে ছিল নানা বাধা। সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে অনেক সময়। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘জন অরণ্য’, ‘সীমাবদ্ধ’—এই ক্যালকাটা ট্রিলজির সময় তাঁকে শুনতে হয়েছে, তিনি নাকি আর ‘পথের পাঁচালী’র রায় নেই। কিন্তু তিনি চুপচাপ নিজের কাজ করে গেছেন, সময়ের সাথে নিজের ভাষা বদলে নিয়েছেন।
আশির দশকে হৃদরোগে আক্রান্ত হন সত্যজিৎ। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকলেও কাজ থামাননি। ‘ঘরে বাইরে’, ‘শতরঞ্জ কা খেলাড়ি’, ‘গণশত্রু’—সবই তখনকার কাজ। তাঁর শেষ দিককার ছবি ‘আগন্তুক’, তাঁর নিজের মতোই এক মরমী বার্তা দেয় সমাজকে।

১৯৯২ সালে, জীবনসায়াহ্নে, যখন তিনি হাসপাতালের বিছানায়, তখনই ঘোষণা করা হয় তাঁকে দেওয়া হচ্ছে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ফর লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট। হাসপাতালের বিছানাতেই তিনি সেই পুরস্কার গ্রহণ করেন। সেদিন তাঁর কণ্ঠে একটাই বার্তা—“আমার বিশ্বাস, চলচ্চিত্রের মাধ্যম দিয়ে আমি বিশ্বজনীন কিছু কথা বলতে পেরেছি।”
সেই বছরের ২৩ এপ্রিল, কলকাতার এক হাসপাতালেই তাঁর জীবনাবসান হয়। কিন্তু সত্যজিৎ রায় রয়ে যান অমর, তাঁর সৃষ্টি আর দর্শনের মধ্য দিয়ে। তিনি শুধুই একজন পরিচালক ছিলেন না—তিনি ছিলেন এক চলমান সময়, যিনি আমাদের চিনিয়ে দিয়েছেন বাস্তবতা, মানবিকতা আর শিল্পের সারল্য।
আজও যখন নতুন পরিচালকরা সিনেমা করতে আসেন, তাদের আলো হয়ে পথ দেখান সেই রায়—যিনি সব বাধা পেরিয়ে নিজের ভাষায় বলেছিলেন গল্প, মানুষের গল্প।