
কলকাতার হিমেল সন্ধ্যা। টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ার মোড়ে বসে আছে এক সদ্য যৌবন পেরোনো ছেলে—নাম অর্ক। চোখে স্বপ্ন, হাতে এক নোটবুক—যেখানে সে লিখে রেখেছে নিজের অভিনয়ের ডায়ালগ, নাটকের লাইন, সিনেমার সংলাপ। ওর চোখে এখনো স্বপ্নের আলো, শহরটা যেন ওকে ডাকছে—একটা সুযোগ, একটা ব্রেক, একটা চরিত্র, যে চরিত্র পাল্টে দেবে ওর জীবন।
ঠিক তখনই, ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা সামনে এনে দিল এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। লালপাড় সাদা ধুতি পরা, পরনে কোট, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা।
“তুমি কি নতুন এসেছো টালিগঞ্জে?”
অর্ক একটু হকচকিয়ে গেল। মাথা নোয়াল—“জি হ্যাঁ, আমি দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে এসেছি। অভিনেতা হতে চাই।”
লোকটা হেসে ফেলল, “সবাই তাই চায়… কিন্তু সবাই পারে না। তবে তোমার চোখে আমি একটা আগুন দেখছি। বসো, চা খাও।”
এটাই প্রথম কাপ চা।
এই প্রথম কাপ চায়েই শুরু হলো পরিচয়, শুরু হলো গল্প। লোকটার নাম অনন্ত শর্মা। নিজেকে পরিচয় দিলেন একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রোডিউসার হিসেবে। বললেন, “আমি অনেক নতুনদের নিয়ে কাজ করি, এখন একটা নতুন স্ক্রিপ্টের জন্য ফেস খুঁজছি। তুমিও চেষ্টা করে দেখতে পারো।”
অর্কের হৃদপিণ্ড ধুকপুক করে উঠল। সে ভাবল, “হয়তো এটাই সেই সুযোগ। মা বলেছিল, ‘একদিন ঠিক দেখবি, কেউ না কেউ তোকে চিনবেই।’”
অনন্ত বাবু তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন পাশের এক ক্যাফেতে—আরও এক কাপ চা এল সামনে।
এটাই দ্বিতীয় কাপ চা।
এবার আলোচনা বদলালো। অনন্ত বললেন, “তুই জানিস, এই চরিত্রটা তোকে ছাড়া আমি কল্পনাও করতে পারছি না। এমন একটা গল্প যেখানে একজন ছেলেকে ছোট শহর থেকে উঠে এসে লড়তে হয় কলকাতার মতো জায়গায়। স্ক্রিপ্টটা তোর জীবনের মতোই!”
অর্ক অবাক! এ তো একেবারে ওর গল্প! কী আশ্চর্য মিল!
“তবে একটা ছোট সমস্যা আছে,” অনন্ত একটু নিচু গলায় বললেন, “ছবিটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট। কিছু ফান্ডিং লাগবে। তুই যদি একটু হেল্প করিস, তোর বাবা-মা যদি সামান্য কিছু খরচ দেয়, আমি তোর স্ক্রিন টেস্ট করিয়ে দেব, প্রোমো বানিয়ে দেব, আর ছবিটা রিলিজ করে দেব। তারপর তোর ক্যারিয়ার একেবারে বদলে যাবে।”
অর্ক কিছুটা দ্বিধায় পড়ল, কিন্তু অনন্ত এমনভাবে বললেন যে মনে হলো, টাকা না দিলে এই স্বপ্নটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে। মা-বাবার জমানো টাকা ছিল, যা দিয়ে পড়াশোনার ভবিষ্যৎ গড়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্ক ভাবল, “এই তো সুযোগ! পড়াশোনা তো পরে করাই যাবে। আগে তো জীবনের ব্রেক!”
সপ্তাহের মধ্যেই টাকা হাতে পেয়ে গেলেন অনন্ত। স্ক্রিপ্ট পড়ানো হলো, অডিশনও করানো হলো একটা ছোট ঘরে। অর্কের মুখে হাসি, মনে উত্তেজনা। দিন যায়, রাত যায়—একদিন অনন্ত বললেন, “চলো, একটা স্পেশাল মিটিং আছে। আমাদের ব্যানারের নামও রেডি—‘স্বপ্নলোক ফিল্মস’। তোর ছবি কলকাতার হোর্ডিংয়ে আসবে।”
তৃতীয় কাপ চা এল সেই মিটিংয়ে।
একটা বড় রেস্টুরেন্টের প্রাইভেট কেবিন। তিনজন মানুষ বসে আছেন—একজন মহিলা, নিজেকে বলছেন ‘ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর’; অন্যজন ক্যামেরাম্যান, আরেকজন বলছে, “আমরা রিলিজের ডেট নিয়েও রেখেছি। কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও জমা দিচ্ছি।”
অর্কের মাথা ঘুরছে—এটা কি স্বপ্ন?
তৃতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিতেই অর্ক চোখ বন্ধ করে দেখল নিজের পোস্টার—হাওড়া ব্রিজের ওপরে একটা হোর্ডিং, যেখানে লেখা ‘অভিনয়ে: অর্ক চক্রবর্তী’। মানুষ হাততালি দিচ্ছে, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসাচ্ছে, সাংবাদিকরা প্রশ্ন করছে…
আর ঠিক তখনই সবকিছু থেমে গেল।
দিন যায়, সপ্তাহ পেরোয়—কিন্তু অনন্ত শর্মার ফোন বন্ধ। অফিসে তালা, স্টুডিওর ঠিকানাও ভুল।
অর্ক ছুটে যায় সেখানে যেখানে প্রথম চা খেয়েছিল—চা দোকানদার বলল, “ওই লোক তো এখানে অনেককে এরকম করে গেছে বাবু, তুমি তো নতুন না…”
সব স্বপ্ন যেন এক মুহূর্তে গলিয়ে পড়ে যায় কাঁচের মতো।
অর্ক ঘরে ফিরে যায়। মা কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছিলেন না, বাবার চোখে কেবল হতাশা। নিজেকে একটা অন্ধকার ঘরে আটকে ফেলে অর্ক। ফোন বন্ধ, দরজা বন্ধ। কেবল একটা প্রশ্ন ওর মনে—“আমি কি ঠকেছি? আমি কি বোকা? না আমি শুধু একটু বেশি বিশ্বাস করেছিলাম?”
দিন যায়… মাস যায়।
একদিন এক সন্ধ্যায়, অর্ক নিজেই একটা ভিডিও বানায়। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলে, ঠকে যাওয়া ছেলেমেয়েদের জন্য একটা সতর্কবার্তা। সেটা আপলোড করে ইউটিউবে। প্রথমে কেউ দেখে না, তারপর ধীরে ধীরে ভিডিও ভাইরাল হয়। সংবাদমাধ্যমে আসে, একাধিক চ্যানেল তাকে ডাকে।
“তুমি তো নিজেই এখন একজন অভিনেতা! অভিনয় না করেও একটা সত্যি গল্প বলেছো,” বলে এক সঞ্চালক।
অর্ক মাথা নোয়ায়, হাসে।
সে এখন প্রতিজ্ঞা করেছে—সে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে থাকবে, কিন্তু সেইসব ছেলেমেয়েদের হয়ে, যারা শুধু তিন কাপ চায়ে নিজেদের স্বপ্ন হারিয়ে ফেলে।
সে এখন একটা থিয়েটার গ্রুপ চালায়—নাম “তিন কাপ চা”—যেখানে শুধু সেই ছেলেমেয়েদের সুযোগ দেওয়া হয় যারা হার মেনেও আবার দাঁড়াতে চায়।
কারণ চা যেমন তৃতীয় কাপে ঠান্ডা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি স্বপ্নও একসময় নিভে যেতে বসে।
কিন্তু, যদি মন চায়—তাহলে আবার গরম করে নেওয়া যায়।