৩১তম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব ২০২৫

Spread the love

স্টাফ রিপোর্টার, কলকাতা

বর্ণাঢ্য আয়োজন, নক্ষত্র-খচিত উদ্বোধন, বিশ্ব সিনেমার মহোৎসব— এমনই চিরচেনা জৌলুসে শুরু হলো ৩১তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। নবান্ন ও নন্দন চত্বরজুড়ে উৎসবের আবহ শুরু হয়েছে কয়েকদিন ধরেই, আর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সূচনা হলো বাংলা ও বিশ্ব চলচ্চিত্রের এই সম্মানজনক আসরের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে ধুমধাম করে উৎসবের উদ্বোধন হয়, সঙ্গে ছিলেন বলিউড, টলিউড, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতের বহু তারকা ও বিশিষ্ট অতিথি।

এবারের উৎসবে অংশ নিচ্ছে বিশ্বের প্রায় ৭০টির বেশি দেশ। প্রদর্শিত হবে ২০০-২৫০টিরও বেশি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা। নন্দন, রবীন্দ্র সদন চত্বর, চিত্রভবন, শিশির মঞ্চ, পূর্বাশা, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট সহ শহরের একাধিক প্রেক্ষাগৃহে একসঙ্গে প্রদর্শনী চলছে। দর্শকদের জন্য সাবটাইটেল সহ আন্তর্জাতিক বিভাগের ছবিগুলিও দেখানো হচ্ছে।

এবারের মূল আকর্ষণ পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার নতুন প্রজন্মের নির্মাতাদের চলচ্চিত্র। বিশেষ ফোকাস রয়েছে নারী নির্মাতা, ডকুমেন্টারি, সিনেমাটোগ্রাফি ও টেকনিক্যাল ইনোভেশনের উপর। আয়োজকরা জানিয়েছেন, নতুন নির্মাতা ও ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দিতে আলাদা সেকশন রাখা হয়েছে যেখানে চলচ্চিত্র স্কুল, চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউট ও স্বাধীন তরুণ পরিচালকদের কাজ প্রদর্শনের সুযোগ মিলবে।

উৎসবের উদ্বোধনী বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কলকাতা শুধু বাণিজ্য বা সংস্কৃতির রাজধানী নয়, চলচ্চিত্রেরও আন্তর্জাতিক মিলনক্ষেত্র। সারা বিশ্বের শিল্পীরা এখানে এসে নিজেদের কাহিনি, সংস্কৃতি ও স্বপ্নকে তুলে ধরেন। আমরা সিনেমাকে শুধু বিনোদন নয়, মানবতার ভাষা হিসেবে দেখি।’’ উদ্বোধনী মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বলিউডের কয়েকজন বিশিষ্ট অভিনেতা, পরিচালক ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতের প্রতিনিধি।

এবারের উৎসবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে বাংলাদেশের ছবির বিশেষ উপস্থিতি থাকছে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার বেশ কিছু সিনেমা দেখানো হবে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নির্মাতা, অভিনেতা–অভিনেত্রীরা যৌথভাবে প্রিমিয়ারে অংশ নেবেন— যা দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনকে আরও দৃঢ় করবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি, পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, জাপান ও আর্জেন্টিনার সিনেমাও আলোচনার কেন্দ্রে।

নন্দন চত্বরে সাধারণ দর্শকদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিদিনের মতো এবারও অনলাইন টিকিট বুকিংয়ের সাথে সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে কুপন সংগ্রহের ছবিও দেখা গেছে। অনেকেই ভোরবেলা থেকে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন প্রিয় ছবির শো ধরার জন্য। তরুণ-তরুণী, ছাত্রছাত্রী, ফটোগ্রাফার, সিনেমাপ্রেমী— সবাই মিলে নন্দন চত্বরে উৎসবের আমেজ।

উৎসব পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে বিশেষ প্রযুক্তি, প্রজেকশন ও ডিজিটাল সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। বেশ কিছু প্রেক্ষাগৃহে বয়স্ক নাগরিক, প্রতিবন্ধী, চাক্ষুষ–অক্ষম দর্শকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

এবার থাকবে বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, মাস্টার ক্লাস, আলোচনা সভা ও অভিনেতা-পরিচালকদের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন। সিনেমার ইতিহাস, সম্পাদনা, সিনেমাটোগ্রাফি, স্ক্রিপ্টরাইটিং, ডকুমেন্টারি নির্মাণ— নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন আন্তর্জাতিক নামকরা বিশেষজ্ঞরা। উৎসবের অন্যতম জনপ্রিয় আকর্ষণ হলো ওপেন-এয়ার স্ক্রিনিং, যেখানে বড় পর্দায় যাদবপুর, নানা কলেজ ও পাবলিক স্কোয়ারে সিনেমা দেখানো হবে।

উৎসব চলবে মোট সাত দিন। সমাপনী দিনে সেরা সিনেমা, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রী, সেরা ডকুমেন্টারি ও অন্যান্য বিভাগে পুরস্কার প্রদান করা হবে। আয়োজকদের আশা— এবারের উৎসব কলকাতার চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির ইতিহাসে নতুন মানদণ্ড তৈরি করবে।

বিশ্ব সিনেমার সঙ্গে বাঙালির আবেগের এক সেতুবন্ধন— সেটাই যেন আবারও প্রমাণ করে দিল ৩১তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। সিনেপ্রেমীদের চোখ এখন বড় পর্দায়, আর শহর আবার ফিরে পেল তার প্রিয় উৎসব— মুক্ত, বৈচিত্র্যপূর্ণ, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের রঙিন সমাবেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *